Website Logo

Sunday, July 27, 2025 11:28 AM

ড. ইউনূসের কূটনৈতিক কৌশলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন অধ্যায়"

ড. ইউনূসের কূটনৈতিক কৌশলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন অধ্যায়"
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে ২০২৫ সালের এপ্রিলে, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন। ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক শুধু দুই নেতার পরিচিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক উত্তেজনা নিরসনের এক তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ।
অতীতের ছায়া ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

গত এক দশকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি জটিল পর্যায় অতিক্রম করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ভারত-সমর্থিত বলে অনেকেই মনে করলেও, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি রাজনৈতিক সংকটে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার পর সম্পর্কের রসায়ন পরিবর্তিত হয়। এই পটভূমিতে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন প্রশাসনের জন্য ভারতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক বার্তা পৌঁছানো ছিল অত্যন্ত জরুরি।

মোদি-ইউনূস বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু

বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় বিষয়ে আলোচনা হয়। মোদি একদিকে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার প্রতি ভারতের অবিচল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন, অন্যদিকে ড. ইউনূসও বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন।

নরেন্দ্র মোদি বিশেষভাবে জোর দেন দুই দেশের মধ্যে বিভাজনমূলক বক্তৃতা এড়ানোর ওপর, যা পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ভারত-বিরোধী আবেগ উসকে দেওয়ার প্রবণতার কারণে কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, নতুন নেতৃত্বের অধীনে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও বাস্তবভিত্তিক এবং পারস্পরিক উপকারভিত্তিক হবে।
কূটনৈতিক বার্তা ও ভারতের উদ্বেগ

মোদি বৈঠকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় সহনশীলতা প্রসঙ্গে সরাসরি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ভারত, যা নিজেই একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র, তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রেও এই নীতিমালার প্রতিফলন দেখতে চায়। ড. ইউনূস এই বিষয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক বাংলাদেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন।

এছাড়াও, ভারতের উদ্বেগ ছিল সীমান্তে চোরাচালান, অনুপ্রবেশ ও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়েও। ড. ইউনূস প্রতিশ্রুতি দেন যে এসব ইস্যুতে উভয় দেশ সম্মিলিতভাবে কাজ করবে এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও আঞ্চলিক সহযোগিতা

বৈঠকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রসার। ভারত চায় বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ করতে এবং বিদ্যুৎ, রেলপথ ও ডিজিটাল কানেক্টিভিটি বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে। ইউনূসের সরকার এই সম্ভাবনাগুলোর সদ্ব্যবহার করতে প্রস্তুত। বিশেষ করে, বাংলাদেশ চায় দক্ষিণ এশিয়ায় একটি সংযুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে, যাতে বাংলাদেশ ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।
পররাষ্ট্র নীতিতে ইউনূসের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

ড. ইউনূস তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও নোবেল বিজয়ের মর্যাদা ব্যবহার করে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী। ভারত সফরের মাধ্যমে তিনি একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির ইঙ্গিত দিয়েছেন, যেখানে বাংলাদেশ চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে কৌশলগত সমতা বজায় রাখবে।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা

বিশ্লেষকদের মতে, মোদি-ইউনূস বৈঠক ছিল একটি 'সফট রিসেট' – যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুনভাবে বিন্যস্ত করার সুযোগ এনে দিয়েছে। ভবিষ্যতে উভয় দেশের মধ্যে যে কয়েকটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রত্যাশিত তা হলো:

    ট্রেড ও ট্রানজিট: ভারত চাইছে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল ট্রানজিট সুবিধা আরও সম্প্রসারিত হোক।

    সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা: ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে উদ্ভূত সামাজিক উত্তেজনা নিরসনে বাংলাদেশ সরকার উদ্যোগ নেবে।

    জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা: গঙ্গা ও তিস্তা নদী নিয়ে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা আবার শুরু হতে পারে।

    উচ্চপর্যায়ে সফর বিনিময়: আগামী মাসগুলোতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সম্ভাবনা রয়েছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে।

মোদি-ইউনূস বৈঠক শুধু দুটি দেশের প্রধানের মধ্যকার সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সময়োপযোগী ও কৌশলগত পদক্ষেপ। এই বৈঠকের মাধ্যমে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিশ্বাসহীনতা কাটিয়ে একটি নতুন অধ্যায় রচনা হয়েছে।

যদি এই কূটনৈতিক উদ্যোগ গঠনমূলকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোয় বাংলাদেশ-ভারতের অবস্থান আরও দৃঢ় হবে এবং অঞ্চলটি আরও স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধির পথে এগোবে। ড. ইউনূসের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য, স্বচ্ছতা ও অন্তর্ভুক্তির বার্তা ভবিষ্যতের বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচিত হবে।